# ইয়াসমীন জিনাত
শ্বশুর বাড়ীতে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেল। বাসে ঢাকা থেকে রাজশাহী, সত্যি অনেকটা পথ।হাইওয়ের জ্যামে নাজেহাল অবস্থা আমার।রিক্সা গেটের কাছে থামতেই চোখে পড়লো – “”আশীর্বাদ””। আমার শাশুড়ির দেয়া নাম।নতুন বউ হয়ে যখন এসেছিলাম, বলেছিলেন-“”অনেক মানুষের দোয়া আর আশীর্বাদ ছিল বলেই তিনি এই বাড়ী করতে পেরেছেন””।
এবার আমি শ্বশুর বাড়ীতে একাই এসেছি। কিছু কাজ আর সবার সাথে দেখা করাও হবে এ উদ্দেশ্যে। শাশুড়ির বয়স হয়েছে। এখন তিনি আর আগের মত হাঁটাচলা করতে পারেননা।সারাদিন ঘরেই থাকেন।
সৌজন্য সাক্ষাৎ সেরে আমার ক্লান্ত শরীর কেবলি একটি শয্যা খুঁজছে।
এ পরিবারটি মাতৃতান্ত্রিক।অবশ্যই তিনি সে যোগ্যতা রাখেন।আমার শাশুড়ি একাধারে রূপবতী, গুণবতী এবং বড় মনের মানুষ।কোন ঐশ্বরিক শক্তিতে তিনি সবকিছু সুন্দর ভাবে সামলে নেন।মেহমান এলে দুদিনের জায়গায় তাদের আটকে রাখেন সাতদিন। নিজেই ঝক্কি সামলান।এখন তাঁর বয়স হয়েছে, তেমনটি আর পারেন না।
তিনি পরিবারের প্রধানমন্ত্রী। একসময় আমার শ্বশুর প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন। এখন তাঁর অবর্তমানে বড় ছেলে ও ছোট ছেলে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। আমার ছোট জা রিপা হোম মিনিস্টার আর আমি বড় বউ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছি। মেহেরজান বুয়া প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব।দু’জন নাতি তাঁর উপদেষ্টা কমিটিতে আছে।পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সাধারণ সদস্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
খুব সকালে আমার ঘুম ভাঙলো।ভোর পাঁচটা।সূর্যমামা একটু একটু চোখ মেলছেন।আমার হাতে লাগানো গাছগুলোকে দেখতে বাগানে যেতে খুব ইচ্ছে হলো।সেই সাথে জন্মভূমির রাস্তায় হাঁটাহাঁটির তাগিদ প্রচন্ড ভাবে অনুভব করলাম।রেডি হয়ে বেরুতেই দেখলাম মেইন গেটে তালা ঝুলছে।বাড়ীর সবাই ঘুমে অচেতন।চাবি একা একা খুঁজে পেলাম না।
নিজেকে কারাগারে বন্দীর মত মনে হলো।আবারো নিজ শয্যায় ফিরে পুরানো স্মৃতি রোমন্থনে বিভোর হলাম।
সকাল দশটায় শ্বাশুড়ির কাছে গেলাম ।মান-অভিমান,অভিযোগের খাতা খুলে বসলেন তিনি।
নিজেকে শুধু মাত্র শ্রোতা না একজন আসামিও মনে হলো।
এবার তার বিছানার মাথার দিকে, জাজিমের নীচে রাখা একটি চাবি খুঁজে দেবার আদেশ প্রাপ্ত হলাম আমি।যথারীতি চাবিটি তাঁর হাতে দিতেই তিনি সিন্দুক খুলে গয়নার বাক্সটি বের করতে বললেন।
এত বছর এ বাড়ীর বড় বউ হয়ে এসেছি, কখনো এ সিন্দুক খোলার সৌভাগ্য হয়নি।আজ এ সৌভাগ্যে ভিতরে ভিতরে রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। ইয়া বড় এক লম্বাটে চাবি ঢুকিয়ে প্যাঁচ ঘুরাতেই সিন্দুক খুলে গেল।শাশুড়ির গোপন জগৎ আমার চোখের সামনে দ্বার মেলে অবলোকিত হল।বিভিন্ন কাগজ,সম্ভবত দলিলপত্র হবে সেখানে রাখা আছে।একটি কাঠের বাক্স নজরে পড়লো।সেটিই গয়নার বাক্স হবে নিশ্চয়।
কালো রঙের উপর পিতল আর তামার কারুকাজের নকশায়, গয়নার বক্সটি আমার নজর কাড়লো।
বের করে তাঁর হাতে দিলাম।
তিনি বাক্সটি খুলতে বললেন।আদেশ পালন করলাম।ভিতরে কালো ভেলভেটের কাপড়ে মোড়ানো।সেখানে সযতনে রাখা একটি সোনার হার,একটি গলার চেইন, একটি লাল রুবি পাথরের আংটি।
আমি তাঁর কথা শোনার অপেক্ষায় থাকলাম।
– আমি মরে গেলে যে আমারে গোসল দিবে তারে আংটি দিবা। তুমি বাড়ির বড় বউ তোমাক জানায় রাখলাম।
– আপনি আরো অনেকদিন আমাদের মাঝে থাকবেন মা।
খামোখা এগুলো বলবেন না।
– নাগো মা বয়স হয়ছে।
আংটি তোমার কাছে রাখো। আমার শরীল বড্ড খারাপ। বাড়ীতে নানা ম্যানসের আনাগোনা। কখন চুরি যাবে।
– ঠিক আছে মা আপনার ইচ্ছে মতই সব হবে।তবে অহেতুক দুশ্চিন্তা করবেন না।
আমি আংটিটি নিজের কাছে রাখলাম।
ইতিমধ্যে আমার একমাত্র ছোট জা রিপা কলকল- ছলছল করতে করতে ঘরে ঢুকেই হারটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল।তারপর আয়নার সামনে নিজের গলায় হারটি মেলে বললো –
ওমা কি সুন্দর হার!
মা আপনি কি ভাবীকে এটা দিয়ে দিচ্ছেন?
শাশুড়ী অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন।
– লক থাক লিপা। কিসত ঘরে ঢুকলু?, দূর হ তুই। ( চুপ থাক রিপা,কেন ঘরে ঢুকেছিস? দূর হ তুই )
রিপা মুখটা কালো করে বিদায় হলো।
বুঝতে পারলাম শাশুড়ীর মেজাজ বিগড়েছে।
শাশুড়ি বললেন- লিপা তো সবাই কে জানায় দিবে গো মা।
-সবাই জানলে কি সমস্যা মা?
-হুলুস্থুল হবে,ক্যাচাল বাঁধবে, জানান যাবেনা।সবাই তোমার মত লয় মা।তুমি বড় মনের মানুষ।
আমি আশ্বাস দিলাম রিপা গোপন রাখবে।
এবার আমি বললাম মা তাহলে এগুলো সিন্দুকে তুলে রাখি।
– তিনি সম্মতি জানালে তাই করে চাবি আবার জাজিমের নীচে ঢুকিয়ে রেখে,আমিও বিদায় নিলাম।
আমার ছোট জা রিপা, বেশ উচ্ছল, চঞ্চল প্রকৃতির।কথা বেশী বলে। বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট।
আমার বেশ লাগে।কারন আমি তার উল্টো প্রকৃতির। শান্ত ও কম কথা বলি।সে ক্লাশ সেভেনে পড়তেই আমার একমাত্র দেবরের সাথে প্রেম করে নিজেরাই বিয়ে করে ফেলে।সে বালিকা বধূ।
একারণে সে শাশুড়ীর চক্ষুশূল।অন্যদিকে ছোট বউমার বাচালতায় শাশুড়ীর কান ঝালাপালা, তাই সম্ভবত তিনি আমার মত সল্পভাষী কে পছন্দ করেছিলেন। প্রায়ই বলেন – আমি পছন্দ করে বড় বৌমাকে এনেছি।
মূলত রিপাই বাড়ীর বড় বউ, কারন সে আমার অনেক আগে বউ হয়ে এসেছে।তবুও অধিকার সুত্রে বা জন্মসূত্রে আমি বড় বউ।
বিছানায় গা কেবল এলিয়েছি ওমনি রিপা আবারও কলকল- ছলছল করতে করতে আমার কাছে এসে বসলো।শুরু হলো তার গল্প।
– আচ্ছা ভাবী ঐ হারটার রহস্য কিছু ধরতে পারলেন?
– আগে কখনোতো আমি দেখিনি, আপনি কি দেখেছেন ভাবী?
– মা আপনাকে কি বললো ভাবী?
-বাবলি কে ফোন করবো?( আমার ননদ)
হাজার জিজ্ঞাসা তার।
– আমি আস্তে ধীরে বললাম – আসলে তুই হঠাৎ চলে এসেই তো সব ভন্ডুল করলি।নিশ্চয়ই উনি কিছু ইঙ্গিত দিতেন হারটির ব্যাপারে।
বেচারীর রিপার মনটা খারাপ।
আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে, আবার শাশুড়ী বলেছেন গোপনীয়তা বজায় রাখতে, তাই কিছুটা কুটনীতিক চালে বললাম – শোন আগেকার মানুষ কিছু গয়না নিজেদের কাছে রেখে দিতেন,শুধুমাত্র একারণে যেন তাদের সেবা যত্ন সবাই ঠিকঠাক করে।আমারতো মনে হয় ঐ হার সেজন্যই আমাদের দেখালেন।আসলে ঐ হার তোরই প্রাপ্য। তুইই তো মাকে সবসময় সেবা-যত্ন করিস।আমিতো এখানে থাকিইনা।বাবলিকে জানাতে বারণ করলাম।একটু ভয়ও দেখালাম, বাবলি জানলে কিন্তু ও মায়ের কাছ থেকে হার নিয়ে নিবে, তোকে দিতে দিবেনা।
এবার খেয়াল করলাম রিপার মুখ উজ্জ্বল হলো।আমি মাথা ধরার অজুহাতে ওকে বিদায় করলাম।
যদিও কূটনৈতিক বুদ্ধি আমার খুবই কম তবুও এবার এই কূটনৈতিক চালটা বেশ কার্যকরী হলো।
রাতে বাবলির সাথে কথা বলে বুঝলাম রিপা মুখ বন্ধ রেখেছে।
এবার একাএকা নিজের বুদ্ধি খাটালাম।মায়ের যত্ন করে মেহেরজান, রিপা নজরদারি করে।আবার মেহেরজানও দমবার পাত্রী নয়।সে পুরোনো মানুষ হিসেবে, রিপাকে প্রয়োজনে খবরদারিও করে। আর আমাকে দেখানো আর না দেখানো একই ব্যাপার, কারণ আমি ঢাকায় থেকে তাঁর তেমন কোন সেবা- যত্ন করতে পারিনা।তাহলে এই হার কার জন্য রেখেছেন তিনি? তাঁর ছেলে- মেয়েদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগেই। এমনকি তাঁর নাতী, নাতনীদেরও বিয়ে হয়েছে কারো কারো।তবে কি কারণ থাকতে পারে?
সব চিন্তা বাদ দিয়ে আমি বের হলাম কাজে।কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে এলো।
আজ সকালে প্রাতঃভ্রমণ সেরেছি।পুরোনো স্মৃতি বারেবারে স্মৃতিকাতরতায় ফেলে দিচ্ছিল।এ রাস্তায় কত হেঁটেছি কখনো প্রয়োজনে, কখনোবা অপ্রয়োজনেও।আজ জীবন- জীবিকার টানে শহর পাল্টেছি।
প্রাতঃরাশ সেরে আবারো গা এলিয়ে ছুটির সুখটুকু অনুভব করছিলাম।আমার ভাষায় -আরাম খাচ্ছি। মেহেরজান এসে সালাম ঠুকে জানালো -ভাবী শাউড়( শাশুড়ী) ডাকিচ্ছে।
মেহেরজান এ বাড়ীর অনেক পুরানো মানুষ।আমার বর যখন দু’তিন বছর বয়সের তখন সে সাত- আট বছরের বালিকা।আমার বরকে কোলে নিয়ে ঘুরতো,খেলা দিত।আবার আমার ছোট মেয়েকেও সে দেখাশুনা করেছে।সে এ পরিবারের সদস্যের মত।
তবে সে একটানা দশ বছর বয়স থেকে এখন অব্দি রয়েছে এমন না।মাঝে মাঝে চলে গেছে,আবার কখনো বিশেষ প্রয়োজনে সে এসেছে।
তার বর্তমান কাজ আমার শাশুড়ির সেবা যত্ন করা।
মেহেরজানের চেহারায় একটা আভিজাত্যের ছাপ আছে।অনেকে তাকে আমার শাশুড়ী ভেবেও বসে।সে এটা বেশ উপভোগ করে।শাশুড়ির তলব দৌড়ে নীচে গেলাম।
দরজা লাগিয়ে দিয়ে আমাকে বসতে বললেন।আমি রোমাঞ্চ অনুভব করলাম।যথারীতি সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর তিনি বললেন- বউ আমার একটা কাজ করে দিতে পারবা?
– কেন পারবোনা মা, আপনি বলেই দেখেন।
– ঐ হারটা দেখলানা সেদিন, ওটা আমার এক সই বন্ধক রেখে কিছু টাকা হাওলাত নিছিল গো মা অনেক আগে।
– কত বছর আগে? কত টাকা?
– তা হবে ধরো দিনি বিশ বছর।ত্রিশ হাজার টাকা গো মা।তখন আমরা পাশাপাশি থাকতাম।অনেক বছর চলে গেল কেউ যোগাযোগ করেনা।
তাছাড়া আগের ভাড়া বাসা ছেড়ে, তোমার শ্বশুর বাড়ী করার পর নতুন ঠিকানা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলাম।কিন্তু কোন উত্তর আসেনি। তাও অনেক বছর হয়ে গেল।
এখন আমি চাচ্ছি ঐ হার সইকে ফেরত দিতে।টাকা আমাকে ফেরত দিতে হবে নাকো।তখনও আমি হারটা রাখতে চাইনি কিন্তু সে জোর করে রেখে গেছে।
– আপনার সই বেঁচে আছেন কিনা কিছু জানেন?
– কিছু জানিনা গো মা
– কোন ঠিকানা আছে? কোথায় ফেরত দিবো?
– একটা ঠিকানা কাগজে লেখা আছে ঐ গয়নার বাক্সত।
আমি আবার সিন্দুক খুলে গয়নার বাক্স বের করলাম। সত্যি একটা ভাঁজ করা হলদেটে কাগজ পেলাম।
শরিফা বেগম
প্রযত্নে- মোঃ ইয়াকুব আলী,
নিরালা ভিলা,
গনক পাড়া,
কাহালু,বগুড়া।
– যদি ঐ ঠিকানায় উনারা না থাকেন তখন কি করবো মা?অথবা উনি যদি বেঁচে না থাকেন তাহলে কার হাতে ফেরত দিবো হার?
– তুমি যান দেনি হার নিয়া বাপু।যদি সই বেঁচে না থাকেন তার ছেলেমেয়ের হাতে তুলে দিবেন।
– আমি জানালাম আগামীকাল আমি হার সহ রওনা দিবো বগুড়ার উদ্দেশ্য। আমার মনে হলো খামোখাই বগুড়া যাওয়া হবে।কাউকে খুঁজে পাবোনা।কিন্তু শাশুড়ী দায়িত্ব দিয়েছেন, এতটা ভরসা করছেন,না করতেও পারছিনা।আর বগুড়ার জন্যও মন আঁকুপাঁকু করছে।
জগৎ সংসারে বড় ছেলে,ছোট ছেলে,বড় বউ,ছোটবউ,বাবলি,মেহেরজান সবাইকেই প্রয়োজন হয়। একজনের কাজ অন্যজনকে দিয়ে হয়না।হয়ত আমার অভিজ্ঞ শাশুড়ী একাজে আমাকেই উপযুক্ত মনে করেছেন।
অনেকদিন পর এ্যাডভেন্ঞ্চারের গন্ধ পেলাম। গেট লক বাসে উঠে রওনা দিলাম বগুড়ার উদ্দেশ্যে। একসময় বগুড়া শহরেও আমি ছিলাম। সেখানকার স্কুলেও পড়েছি।আজ বহুদিন পর আবারও যাচ্ছি বিশেষ এক মিশনে।সময় দ্রুত পালিয়ে যায়,রেখে যায় শুধু স্মৃতি।প্রতিদিন সূর্য ডুবে গেলেই দিনটি স্মৃতির পাতায় যোগ হয়ে যায়।
আড়াই ঘন্টায় আমি বগুড়ায় পৌঁছে গেলাম। অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে আমি চারিদিকে স্মৃতির পাহাড় দেখতে পেলাম।
মালতীনগর,আটাপাড়া ওয়াপদা কলোনী,ভি এম স্কুল আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
কিন্তু আমি একটা মিশনে এসেছি, অতএব সে কাজেই এগিয়ে যেতে হবে।তাই একটা সিএনজি চেপে কাহালুর উদ্দেশ্য রওনা হলাম। এক ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম কাহালু।একটা রিক্সা নিয়ে রওনা দিলাম গনক পাড়ার উদ্দেশ্যে।একটু খোঁজ খবর করতেই নিরালা ভিলা পেয়ে গেলাম।
সাদা দোতলা বাড়ী।অনেক বছর সংস্কার হয়নি।তবে নিরালা ভিলা মোটেই নিরালা মনে হলোনা। বেশ হৈ হুল্লোড় চলছে। সম্ভবত সেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। সামিয়ানা টাঙানো। দুপুরের খাবার আয়োজন শুরু হয়ে গেছে।
আমাকে দেখেই অতিথি ভেবে খাবার প্যান্ডেলে যেতে অনুরোধ করলো এক যুবক।
আমি জিজ্ঞেস করলাম এটা কি ইয়াকুব আলী সাহেবের বাড়ী?আমি উনার স্ত্রী শরিফা বেগমের সাথে দেখা করতে চাই। ছেলেটি চিনলোনা।বুঝলাম বৃদ্ধদের কেউ নামে চিনেনা।তাঁরা দাদী ,নানী,চাচী,ভাবী নামেই পরিচিত হয়ে যায়, সময়ের আবর্তে হারিয়ে যায় নিজের সুন্দর নামটি।আমার নামটিও হয়ত একসময় হারিয়ে যাবে।
ছেলেটিকে বললাম এ বাড়ীর ছেলে বা মেয়ের সাথে আমি দেখা করতে চাই। ছেলেটি একটু পরে একজন মাঝবয়সী মানুষ কে হাজির করলেন।আমি ইয়াকুব আলী ও শরিফা বেগমের নাম জানালাম।উনি বললেন বাবা বেঁচে নেই, মা আছেন। আসুন আমার সাথে।আমি উনার ছোট ছেলে।
যে ঘরটিতে নিয়ে গেলেন সেটি একটা স্টোর রুম মনে হলো।খুব ছোট। সেখানে এক শীর্ণকায় বৃদ্ধা শুয়ে আছেন।ঘর মানব শূণ্য। সাধারণত বৃদ্ধ মানুষের সাথে কেউ সময় কাটাতে চাইনা।তাঁরা বেশি কথা বলেন।
আমি সালাম বিনিময় করে জানালাম রাজশাহী থেকে এসেছি। আমার শাশুড়ীর পরিচয় দিতেই শরিফা বেগমের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
আমি জানালাম তাঁকে আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য।
তিনি বললেন আমিতো টাকা দিতে পারিনি মা,কোন মুখে এ হার নিবো।আমার অভাব অনটনের সংসার। সংসার বড় হয়েছে আর আমাকে নিজের ঘরও ছেড়ে দিতে হয়েছে।আমার আশ্রয় হয়েছে স্টোর রুমে।
আমার মনে হলো আমিও কি একদিন এই বৃদ্ধার মতন
পরিত্যক্ত আসবাবে পরিনত হবো?
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কিছু বলতে পারলামনা।
একটু সামলে নিয়ে বললাম,
আপনার সই হারটি ফেরত পাঠিয়েছেন।অনেকদিন আপনারা যোগাযোগ করেন না।
আপনার সই টাকা নিবেননা।এই না হলে আর কিসের বন্ধুত্ব। আপনি মেনে নিন।
উনি মৃদু হাসলেন।
জানালেন আজ তার বড়ছেলের ছোট মেয়ের, তার নাতনীর বিয়ে।
– উনি বললেন সবই আল্লাহর ইচ্ছা মা।
আমি তাঁর হাতে হারটা তুলে দিলাম। তিনি নেড়ে চেড়ে দেখলেন।চোখে তার আনন্দ অশ্রুধারা!
আমি এ বাড়ীতেও কিছু কুটনৈতিক চাল দিলাম।
উনাকে বললাম এ হার এখন আপনার হাতের পাঁচ।এটাকে ব্যবহার করেই আপনি আপনার নায্য পাওনা আদায় করে নিবেন বুদ্ধি খাটিয়ে।
আমি মোবাইলে আমার শাশুড়ীর সাথে তাঁর সইয়ের কথা বলিয়ে দিলাম। অনেকক্ষণ ধরে চললো তাদের আলাপ।
আমাকে প্রীতিভোজে অংশ নিতে হলো।
আমার কেবলি মনে হতে লাগলো সবই বিধাতার খেলা।আমরা তাঁর ইচ্ছের নাটকের পাত্র-পাত্রী মাত্র।
মানুষের জীবনের ঘটনা নিয়েই তৈরী হয় নাটক,উপন্যাস। কখনো আমরা বলে থাকি এ শুধু নাটকেই সম্ভব বাস্তবে নয়।আজ নিজে বুঝলাম এ ধারণা ভুল।
তারা অনেক অনুরোধ করলেন রাতটা থাকবার জন্য। কিন্তু আমার ছুটি শেষ।আগামীকাল সকালেই আমাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে।তাই আমি বেরিয়ে পড়লাম। আমার মিশন সাকসেসফুল। এত শান্তি পেলাম মনটায়।পাওয়ার থেকে দেওয়ার আনন্দ বহু গুণ বেশী আবারও মনে হলো।মনে মনে ঠিক করলাম রিপাকে একটা হার গিফট করবো।
বগুড়ায় গেটলক বাসে উঠে রওনা হলাম রাজশাহীর উদ্দেশ্য।
আমি আবারও শাশুড়ির আশীর্বাদ নিতে পৌঁছে গেলাম আশীর্বাদ ভবনে।
[September 16, 2021 published at JAR BOOK ]
কবি ও লেখক পরিচিতি
Yesmin Zeenat
Physician
64,Central Road , Flat:6B, Dhanmondi , Dhaka-1205